পেজ শিরোনাম: জন্মদাগ (birth marks)- কারণ, প্রকারভেদ ও চিকিৎসা
Highlights
- ● জন্মদাগ, যাকে বিউটি মার্কস নামেও ডাকা হয়, মহিলা ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই দেখা যায়।
- ● এর প্রকৃতির উপর এর ব্যাপকতা (prevalence) ও প্রাদুর্ভাব (incidence) নির্ভর করে।
- ● এটি ভ্রূণের ক্রমবিকাশের সময় পিগমেন্ট (pigment) কোষ (মেলানোসাইট) (melanocyte) বা রক্তনালীর (capillaries) বিকৃতি বা বিস্তারের জন্য হতে পারে।
- ● পরিবারে অন্য কারুর ইতিহাস থাকতে পারে, বা নতুন করে দেখা দিতে পারে (acquired)।
- ● চর্মবিশেষজ্ঞরা আপনার জন্মদাগের চিকিৎসা করতে পারে। চিকিৎসার সময় ও পদ্ধতি দাগের প্রকৃতি, মাপ ও অবস্থানের উপর নির্ভর করে।
- ● চিকিৎসা না করলে জন্মদাগের পরিণতি নানা রকম হতে পারে। এগুলি আকারে বাড়তে পারে, বা যন্ত্রণা দিতে পারে, এটি থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, এতে চুলকানি, প্রদাহ বা ঘা হতে পারে; এমনকি এটি বয়সের সাথে নিজে নিজে সেরেও যেতে পারে।
জন্মদাগ কি?
জন্মদাগ হল ত্বকের এমন জায়গাগুলি যেখানে ত্বকের রং পরিবর্তন হয়েছে, সঙ্গে মসৃণতারও পরিবর্তন হয়ে থাকতে পারে; যা ভ্রূণ অবস্থায় ত্বককোষ বা রক্তনালী গঠনের সময় সমস্যার জন্য দেখা দেয়।
জন্মদাগ শরীরের যে কোনো অংশে হতে পারে। কিছু ত্বকের উপরে হয়, কিছু নীচে।
জন্মদাগ সাধারণতঃ জন্মের সময় বা শিশুবেলায় (প্রথম পাঁচ বছর) স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিছু ক্ষেত্রে খুব ছোট আকারের হলে একটু বয়সের সাথে বড় হয়ে উঠলে তবে লক্ষ্য করা যায়।
প্রকারভেদ ও শ্রেণীবিন্যাস
জন্মদাগকে আমরা দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি: রক্তনালী-সম্পর্কিত (vascular) (যা রক্তনালী থেকে তৈরি) এবং পিগমেন্ট-সম্পর্কিত (pigmented) (যা পিগমেন্ট কোষ অর্থাৎ মেলানোসাইট থেকে তৈরি; এই কোষগুলি মেলানিন নামক পিগমেন্টটি তৈরি করে ত্বকের রং ঠিক করে)।
● নেভাস ফ্লেমিয়াস/ পোর্ট ওয়াইন স্টেন (Naevus flammeus/ Port Wine Stain): পোর্ট ওয়াইন স্টেনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় নেভাস ফ্লেমিয়াস বলা হয়। এগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুখে দেখা যায়, কিন্তু শরীরের যে কোনো অংশে হতে পারে। জন্মের সময় সমতল, হালকা লাল বা বেগুনি-গোলাপি রঙের দাগ হিসেবে শুরু হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রায়ই গাঢ় লাল বা বেগুনি রঙে পরিণত হয়, এবং উপরের চামড়া আশেপাশের ত্বকের চেয়ে মোটা হয়ে যায়। দলা পাকিয়ে উঠে রক্তক্ষরণও হতে পারে। ঠোঁটে বা নাকে হলে জায়গাটি ফুলে ওঠে। এগুলি নিজে থেকে সারে না। ১০০০ শিশুর মধ্যে প্রায় ৩ জনের (০.৩%) জন্মের সময় একটি পোর্ট ওয়াইন স্টেন থাকে।
● ম্যাকুলার স্টেন- স্টর্ক বাইট/ এঞ্জেল’স কিস (macular stains-stork bite/angel’s kiss): চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম নেভাস সিমপ্লেক্স (Naevus Simplex)। একটি সমতল গোলাপি অনিয়মিত জায়গা হিসেবে ত্বকে দেখা যায়। এই ম্যাকুলার স্টেন বা স্যালমন প্যাচ (salmon patch) যখন দেহের সামনের দিকে থাকে (কপাল, নাকের গোড়া, চোখের পাতা, উপরের ঠোঁট) তখন তাকে বলে “এঞ্জেল’স কিস”, আর যখন পিছন দিকে থাকে (ঘাড়ের উপরিভাগে) তখন তাকে বলে স্টর্ক বাইট। এর প্রাদুর্ভাব হল ২০-৬০%। জন্মের প্রথম বছরের মধ্যে অধিকাংশ ম্যাকুলার স্টেন নিজেই মিলিয়ে যায়।
● হিমানজিওমা (hemangiomas): হিমানজিওমাগুলিকে ত্বকের উপর উঁচু লালচে-গোলাপি দলার মত দেখতে লাগে। কিছু ত্বকের উপরে হয়, অগভীর (স্ট্রবেরি মার্কস) (strawberry marks), এবং কিছু ত্বকের গভীরে হয়। ৫০%-এর বেশি মাথা ও গলায় দেখা যায়। সাধারণতঃ বয়সের সাথে এগুলি মিলিয়ে যায় (৯ বছরে ৯০%)। শরীরে অবস্থানের উপর নির্ভর করে এগুলিতে জটিলতার ঝুঁকি থাকতে পারে; অনেক সময় কিছু বিশেষ সিনড্রোমের (syndrome) সঙ্গে যুক্ত থাকে।
● ডার্মাল মেলানোসাইটোসিস (dermal melanocytoses): এগুলি হল সমতল, নীলচে-ছাই রঙের ত্বক যেগুলো কালশিটের মত দেখতে হয়। শরীরের কোন অংশে আছে তার উপর নির্ভর করে চর্মবিশেষজ্ঞরা এদের মঙ্গোলিয়ান স্পট (Mongolian spot), নেভাস অফ ওটা (Nevus of Ota) বা নেভাস অফ ইটো (Nevus of Ito) নাম দিয়েছেন। এগুলির কারণ হল ত্বকের গভীর স্তরে পিগমেন্ট কোষ বা মেলানোসাইট অস্বাভাবিকভাবে থেকে যাওয়া।
● কনজেনিটাল মেলানোসাইটিক নেভাস (congenital melanocytic nevi) (CMN) (সিএমএন): এগুলি হল সমতল বা উঁচু জন্মদাগ যা রঙে হালকা বাদামি থেকে কালো অবধি হতে পারে এবং বিভিন্ন আকার ও মাপের হতে পারে (১.৫ সেমির কম থেকে ২০ সেমির বেশি)। কিছু নেভাস থেকে চুলও গজাতে পারে। ১০০ জনে ১ জন ব্যক্তির (১%) জন্মের সময় এক বা একাধিক সিএমএন থাকতে পারে। সাধারণতঃ জন্মের পরের এক বা দু বছরে এগুলি হালকা হয়ে যায়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে এগুলি কোনো বিশেষ সিনড্রোমের দিকে ইঙ্গিত করতে পারে।
● কাফে-অ-লে স্পট (café-au-lait spots): কাফে-অ-লে ম্যাকুল (CALM)(সিএএলএম) হল হলদেটে বা হালকা বাদামি সমতল ছোট ছোপ, আকারে সাধারণতঃ ডিম্বাকৃতি। জাতির সঙ্গে এর প্রাদুর্ভাব পরিবর্তন হয় (০.৩-১৮%)। ছটি বা তার বেশি স্পট থাকলে তা নিউরোফাইব্রম্যাটোসিসের (neurofibromatosis) চিহ্ন হতে পারে।
জন্মদাগের কারণ কি?
চিকিৎসাবিজ্ঞান জন্মদাগ তৈরি হওয়ার কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করে উঠতে পারেনি। অধিকাংশ নিজের থেকেই হয় এবং অন্য কোনো অসুখ বা শারীরিক সমস্যার সাথে জড়িত থাকেনা। কয়েকটি জন্মদাগ অন্য বেশ কিছু সমস্যার সাথে সংযুক্ত হয়ে একটি সিনড্রোম তৈরি করতে পারে।
● রক্তনালী-সম্পর্কিত (vascular) জন্মদাগ – এগুলি রক্তনালী/কৈশিক নালীর গঠনগত ত্রুটির ফলে দেখা যায়- অনেকগুলি একই জায়গায় জড়ো হয়ে থাকতে পারে, বা ছড়িয়ে থাকতে পারে।
● পিগমেন্ট-সম্পর্কিত (pigmented) জন্মদাগ – মেলানোসাইট নামে ত্বককোষ মেলানিন পিগমেন্ট তৈরি করে। পিগমেন্ট-সম্পর্কিত জন্মদাগ দেখা যায় যদি পিগমেন্ট কোষগুলি অস্বাভাবিক ভাবে ত্বকের এক জায়গায় জড়ো হয় বা বিস্তার করে।
চিহ্নিত করা ও পরীক্ষা করা
একজন চর্মবিশেষজ্ঞ জন্মদাগ চিহ্নিত করতে জায়গাটি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করবেন। তিনি প্রয়োজনে ডার্মাস্কোপ (dermascope) যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারেন।
গভীর দাগ হলে আপনার ডাক্তার ইমেজিং (imaging) পরীক্ষা করাতে বলতে পারেন (আল্ট্রাসাউন্ড, সি টি স্ক্যান, এমআরআই) (Ultrasound, CT scan, MRI) বা বায়োপসি (biopsy) করে নিশ্চিত হতে চাইতে পারেন।
আপনার ঝুঁকি আছে?
জন্মদাগ সাধারণভাবে নিরীহ জিনিস। কিছু তো সময়ের সাথে হালকা হয়ে যায় বা মিলিয়ে যায়। তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে, জন্মদাগ শিশুর সুস্থ বিকাশ বা শরীরের কাজে বাধা দিতে পারে, বা অন্য কোনো অসুখের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে।
স্ট্রবেরি মার্কস-এ অনেক সময় ঘা বা সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মেলানোসাইটিক নেভাস, যা অনেকেরই দেখা যায়, কদাচিৎ ক্যান্সারে পরিণত হতে পারে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
যাদের জন্মদাগ আছে, তাদের নিয়মিত খেয়াল রাখা উচিত এবং রং, আকার বা মসৃণতার কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা প্রয়োজন। যদি দাগে কোনো ব্যথা, রক্তপাত, চুলকানি বা প্রদাহ হয় তাহলে তৎক্ষণাৎ চর্মবিশেষজ্ঞর পরামর্শ নিন।
চিকিৎসা বিকল্প
একজন চর্মবিশেষজ্ঞ জন্মদাগ দূর করতে পারেন। সাধারণতঃ একটি জন্মদাগ দূর করার চিকিৎসাপদ্ধতি তার প্রকৃতি, আকার, গুরুত্ব, অবস্থান ও অন্যান্য জিনিসের উপর নির্ভর করে। জন্মদাগ কমাতে যে লেজার (laser) সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সেগুলি হল:
● পিগমেন্ট-সম্পর্কিত জন্মদাগের জন্য কিউ-সুইচড এনডি: য়াগ লেজার (Q-switched Nd: YAG laser)
● রক্তনালী-সম্পর্কিত জন্মদাগের জন্য পালসড ডাই লেজার (Pulsed dye laser)
জন্মদাগে খুব একটা জীবনের ঝুঁকি থাকেনা। কেবলমাত্র যে দাগগুলি শরীরের কার্যকারিতায় বাধা দেয় বা খারাপ উপসর্গ দেখায় সেগুলির চিকিৎসা করা উচিত। একজন চর্মবিশেষজ্ঞ নিশ্চয়ই বড় রক্তনালী-সম্পর্কিত বা ডার্মিসের গভীরের জন্মদাগ ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে নিয়ে ঝুঁকি অনুযায়ী চিকিৎসার পরার্মশ দেবেন।
আপনার দেহে জন্মদাগ থাকলে, ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যের জটিলতা এড়াতে আপনার আজকেই চর্মবিশেষজ্ঞ দেখানো প্রয়োজন।